গোটা দেশ জুড়ে চীনা প্রতারণার জাল বিস্তৃত। অনলাইনের মাধ্যমে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষকে টাকার লোভ দেখিয়ে প্রতারিত করে চলেছে চীনারা। সদ্য চীনা ভাষা শেখা বাংলাদেশী যুবকদের সেই প্রতারণার কাজে নিযুক্ত করে চলেছে দুষ্টুচক্র। প্রতারণার জাল বিস্তারে তাদের সবচেয়ে বড় টার্গেট হচ্ছে চীনে পড়তে যাওয়া বাংলাদেশী যুবকরা। পড়াশুনো শিখুক বা না শিখুক, প্রযুক্তির মাধ্যমে কীভাবে মানুষ ঠকাতে হয় সেটা তাদের শিখিয়ে ফায়দা লুটছে চীনা প্রতারকদের দল। ফলে অগণিত মানুষ চীনাদের হাতে প্রতিনিয়ত প্রতারিত হচ্ছেন।
চীনা জালিয়াতদের হাতে প্রতারণার একাধিক প্রমাণ এসেছে দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি)-এর গোয়েন্দা শাখা (ডিবি)-র প্রধান হারুন অর রশিদ নিজে স্বীকার করেছেন, বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় চাইনিজ প্রতারণার ফাঁদ রয়েছে।
ডিবি প্রধান জানান, চীনে পড়তে যাওয়া বাংলাদেশী শিক্ষার্থীদের টার্গেট করা হয়েছে এই প্রতারণার ফাঁদকে কার্যকর করার জন্য। তাদের দিয়েই বিভিন্ন প্রতারণার কাজ চালিয়ে যাচ্ছে চীনা প্রতারকরা। অনলাইনে মাল্টিলেভেল মার্কেটিংয়ের লোভে ফেলে, অ্যাপ ও জুয়ার সাইট খুলে মানুষের কোটি কোটি টাকা লুট হচ্ছে।
চীনা প্রশাসনও এসব প্রতারণায় যেন নীরব দর্শক। বাংলাদেশের বহু মানুষ দেউলিয়া হলেও বেইজিং এবিষয়ে কোনও পদক্ষেপ না নিয়ে প্রতারকদেরই আড়াল করতে ব্যস্ত। মিলছে শি জিনজিয়াং সরকারের প্রচ্ছন্ন মদদও। কারণ এর ফলে চীনের কোনও ক্ষতি হচ্ছে না। বরং আর্থিকভাবে বাংলাদেশ ক্ষতিগ্রস্থ হলেও তাদের লাভই হচ্ছে। তাই সব সংস্থাই তাদের অনলাইন অ্যাডমিন চীন থেকে নিয়ন্ত্রণ করছে। প্রয়োজনে তারা জালিয়াতির কাজে ভারতীয় সিমও ব্যবহার করছে। সব জেনেও বন্ধুত্বের খাতিরে বাংলাদেশ সরকার কড়া ব্যবস্থা নিচ্ছে না বলেও অভিযোগ উঠছে।
ডিবি প্রধান নিজেই জানিয়ছেন, চীনের মাটিতে বসেও বহু বাংলাদেশী শিক্ষার্থী এই প্রতারণার কাজে চীনাদের সাহায্য করতে বাধ্য হচ্ছে। টাকা রোজগারের টোপ দিয়ে তাদের যুক্ত করা হচ্ছে দুর্নীতিতে। বিভিন্ন প্রলোভনের মাধ্যমে, ভয় দেখিয়ে যুবকদের মগজ ধোলাই চলছে চৈনিক কৌশলে। তারপর তাদের ফেরত পাঠানো হচ্ছে বাংলাদেশে। এরপর বাংলাদেশে ফিরে এই শিক্ষার্থীরাই মানুষ ঠকানোর ব্যবসায় চীনাদের সাহায্য করে চলেছে। অনেকে জানতেও পারছে না বাংলাদেশের মানুষকে তারা চীনাদের পাল্লায় পড়ে ঠকানোর কাজে নিযুক্ত। বাংলাদেশ থেকে বেনামে সিম জোগার করে তা দিয়ে চলছে চীনাদের প্রতারণাচক্র। বেনামি সিম দিয়েই তারা খুলে নিচ্ছে বিকাশ বা নগদ-সহ বিভিন্ন অ্যাকাউন্ট। তারপর জালিয়াতির মাধ্যমে হচ্ছে কোটি কোটি টাকা উপার্জন। এভাবেই দেশের অর্থ পাচার হচ্ছে বিদেশে। বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের পাশাপাশি জাতীয় অর্থনীতিও চীনা ফাঁদে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে।
সম্প্রতি তিন বাংলাদেশী শিক্ষার্থী চীনা প্রতারণাচক্রের ফাঁদে পড়ে পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হয়েছে। এরা হলেন, রাকিবুল ইসলাম রাতুল (২৪), আসাদুজ্জামান রাজু (২৯) এবং মামুন হাওলাদার (২৯)। তারা তিনজনই বাংলাদেশ থেকে পড়ালেখার উদ্দেশ্যে চীনে গিয়েছিলেন। সেখানে গিয়েই তারা প্রতারকদের খপ্পরে পড়েন। তারাই তাদের চীনা ভাষাতেও পারদর্শী করে তোলে। তারপর বন্ধুত্বের মুখোশধারীরা এই তিন যুবককে প্রতারণার এজেন্ট বানিয়ে নেয়। সামান্য কিছু রোজগারের লোভে তারা দেশে ফিরেই মানুষ ঠকাতে শুরু করে। তাদের এই কাজে যুক্ত করার মূল হোতা দুই চীনা নাগরিক, গাগা এবং চিং চং। বাংলাদেশের মানুষকে লুট করার জন্য তারাই ধৃত তিনজনকে ব্যবহার করে। এর পিছনে অবশ্য রয়েছে আরও বড় চক্র। এমনকি, কমিউনিস্ট পরিচালিত চীন সরকারের মদদ রয়েছে বলেও সন্দেহ করা হচ্ছে। প্রতারণার জাল বিস্তারে গাগা এবং চিং চং চীনে একটি সার্ভার স্থাপন করেছিল। সেখান থেকে চিং চং বিকাশ, নগদ-সহ ব্যাংক অ্যাকাউন্ট থেকে শুরু করে মানুষ ঠকানোর ব্যবসা। বাংলাদেশ থেকে টাকা লুট করে ক্রিপ্টো কারেন্সির মাধ্যমে তারা নিজেদের দেশে টাকা পাচার করে।
প্রতারণার কৌশল হিসেবে তারা সংগ্রহ করেছিল একাধিক ফিঙ্গার প্রিন্ট। সেই ফিঙ্গার প্রিন্টকে কাজে লাগিয়ে তারা মোবাইল ফোনের মাধ্যমে শতাধিক বিকাশ অ্যাকাউন্ট খুলে চালাতে শুরু করে তাদের প্রতারণাচক্র। চীনা যুবকদের এই প্রতারণার কাজে সাহায্যের জন্য সামান্য কিছু অর্থের বিনিময়ে বাংলাদেশি যুবকদের কাজে লাগায়। দেশের অর্থনীতির পাশাপাশি শেষ হচ্ছে যুব সমাজও।
বৈধ বা অবৈধভাবে বর্তমানে বাংলাদেশে ১০ থেকে ১২ হাজার চীনা নাগরিক রয়েছেন। দেশের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা এই চীনা নাগরিকেরা পুলিশ ও প্রশাসনকে অন্ধকারে রেখে চালিয়ে যাচ্ছে তাদের জালিয়াতি চক্র। ভূয়া ওয়েবসাইট খুলে অনলাইনে মাল্টিলেভেল মার্কেটিংয়ের প্রলোভন দেখিয়ে তারা মানুষকে সর্বশান্ত করে তুলছে। প্রযুক্তি নির্ভর চীনা জালিয়াতির কৌশল মাঝে মধ্যেই বদলও হচ্ছে। ফলে অনেক সময় তাদের সাইবার অপরাধ গোয়েন্দাদেরও নজর এড়িয়ে যাচ্ছে। যার কূফল ভোগ করছেন সাধারণ মানুষ। সরকারের তরফে আরও বেশি করে সতর্কতামূলক প্রচারণা জরুরি। কিন্তু এক্ষেত্রেও বাধা হয়ে উঠছে চীনপন্থী রাজনীতিবিদ ও আমালদের সক্রিয় বিরোধিতা।
ধৃত রাতুল, রাজু ও মামুন তিনজনই চীনে পড়াশোনা করতে গিয়েছিলেন। সেখানে গিয়েই তারা প্রতারক চক্রের খপ্পরে পড়েন। গোয়েন্দা পুলিশ জানতে পেরেছে, কীভাবে তাদের মগজ ধোলাই করা হয়। প্রতারণায় জড়ানো এই তিন বাংলাদেশি শিক্ষার্থীর কাছ থেকে ৩০টি ভারতীয় সিম উদ্ধার হয়। তাদের জেরা করে উঠে আসছে আরও চাঞ্চল্যকর তথ্য।
অবশ্য বহুদিন ধরেই বাংলাদেশে রমরমিয়ে চলছে চীনাদের এই প্রতারণাচক্র। চলতি বছর ২ জানুয়ারি ঢাকার কলাবাগান থানায় এক ভুক্তভোগীর দায়ের করা মামলার পর বিষয়টি প্রকাশ্যে আসে। রাতুল, রাজু ও মামুনদের গ্রেপ্তারের পর গোয়েন্দারাও নিশ্চিত হন চীনা প্রতারকদের দৌরাত্মের বিষয়ে। অ্যামাজন ডটকম, দারাজ ডটকম, ফ্লিপকার্ট ডটকম, পিকাবো ডটকম প্রভৃতির নকল পোর্টাল খুলে চীনে বসেই নিয়ন্ত্রণ করা করছে বিভিন্ন প্রতারণাচক্র। বহুজাতিক কোম্পানির নাম ব্যবহার করে চীনারা বাংলাদেশের নাগরিকদের প্রতারিত করছে। অনলাইনে পুঁজি বিনিয়োগ করে দ্রুত লাভের আশায় অনেকেই তাদের ফাঁদে পা দিয়ে বিপদ ডেকে আনছেন। কিছুদিনের মধ্যেই তারা বুঝতে পারছেন প্রতারিত হওয়ার বিষয়টি। কিন্তু তখন আর তাদের কিছু করার থাকে না।
আর্থিক ক্ষতির পাশাপাশি ধ্বংস হচ্ছে দেশের যুব সম্প্রদায়ের একটি বড় অংশ। উচ্চশিক্ষার উদ্দেশে মেধাবী ছাত্র-ছাত্রীদের তাদের পরিবার চীনে পড়তে পাঠালে কী হবে, পড়াশুনোর বদলে প্রতারণা শিখে তারা দেশে ফিরছে। আসলে চীনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলির সম্পর্কে বাংলাদেশ সরকারের স্বচ্ছ ধারণা নেই। কারণ সববিষয়েই গোপণীয়তা রক্ষা করাই চীনাদের কৌশল। সঠিক তথ্য কিছুতেই বাইরে প্রকাশ হতে দেয় না অগণতান্ত্রিক দেশ চীনে গণমাধ্যমের ন্যূনতম স্বাধীনতারও বালাই নেই। তাই অন্ধের মতো অনেকেই চীনা ফাঁদে প্রতারিত হয়ে চলেছেন। চাইনিজ আর সর্বনাশ বাংলাদেশের কাছে হয়ে উঠেছে একই মুদ্রার দুপীঠ।
আরও পড়ুন: